দুর্গাপূজা প্রবন্ধ রচনা

বাঙালির প্রিয় উৎসব দুর্গাপূজা – ভূমিকা:

কথায় আছে –

বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বন”।

এই কথার সত্যতা বাংলা ক্যালেন্ডার দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়। সত্যিই প্রায় সারা বছর আমরা বাঙালিরা এক-একটি উৎসের মধ্যে মেতে থাকি। প্রায় সারা বছর জুড়েই বাঙালীর অঙ্গন মুখরিত হয়ে থাকে নানান বৈচিত্রময় উৎসবের মধ্যে দিয়ে। তবে যতই পার্বন বাঙালির জীবনে থাকুক না কেন, সব উৎসবের সেরা উৎসব – বাঙালীর দূর্গোৎসব – দূর্গাপূজা। দূর্গাপূজা বাঙালির কাছে কখনই একটি নিছক উৎসব নয় – এটি বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবেগ।
দূর্গোৎসব বা দূর্গাপূজা হল বাঙালির জীবনের একমাত্র উৎসব, যেই উৎসবের ৪-৫ টি দিনের জন্য বাঙালি অপেক্ষা করে থাকে একটি গোটা বছর। শিশির ভেজা দুর্বা ঘাসে ঝরে পড়া শিউলি ফুলের গন্ধ আর তুলোর মত কাশফুলের দোলা বাংলার মাঠ, ঘাট, নদী, প্রান্তর জানান দেয় মায়ের আগমনী বার্তা, বাঙালীর দীর্ঘ এক বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটে মহালয়ার শুভ বন্দনাতে, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বনিত নির্বিশেষে মিলন উৎসব হল এই দূর্গাপূজা, সমগ্র দেশ তথা পৃথিবীর কাছে দূর্গাপূজার রুপ অভাবনীয় এবং অভিনব।

বাঙালির সবচেয়ে আনন্দ আবেগের প্রিয় উৎসব দুর্গাপূজা। শরতের শিশির ভেজা আগমনীর আবাহনে পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ আর সাদা কাশ ফুলের অপরূপ প্রকৃতির মাঝে দেবী আসেন জীবনের উৎসারিত আলো নিয়ে। নারী শক্তির অন্যন্য রূপ মহিষাসুর মর্দিনী দেবী দুর্গা আসেন সকল অন্ধকার দূর করে মুক্তি ও জাগরণের আলোকশিখা নিয়ে। সেই জগৎ জননী মা দুর্গাকে কেন্দ্র করে এই জনপ্রিয় উৎস দুর্গাপূজা। এই উৎসবে বাঙালিরা নতুন সাজে সেজে উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে।

দুর্গাপূজা – পৌরাণিক ভাবনা:

সুদূর অতীতে দুর্গাপূজা প্রথম কবে, কোথায়, শুরু হয়েছিল তা বলা কঠিন। তবে দুর্গাপূজার সূচনা সম্পর্কে হিন্দু পুরাণে বিভিন্ন কাহিনী বর্ণিত আছে।

কৃত্তিবাস রচিত রামায়ণ অনুসারে, শ্রী রামচন্দ্র সীতা দেবীকে উদ্ধারের জন্য লঙ্কাপতি রাবণের বিরুদ্ধে চরম যুদ্ধের পূর্বে ১০৮ টি নীল পদ্ম সহযোগে অসময়ে শরৎ কালে দেবী দুর্গার পূজার আয়োজন করেন – যা অকালবোধন নামে খ্যাত। সেই অকালবোধনের মতো সমগ্র বাঙালি জাতি যেন সংকট মোচনে দেবীর আহবান করেন ।
আবার আরেকটি প্রচলিত মত অনুসারে, রাজা সুরথ তার হারিয়ে যাওয়া রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য বসন্ত কালে দেবীর পূজা করে যা বসন্তী পূজা। দেবী ভাগবত পুরাণ আরো অন্যান্য পুরাণে দেবী পূজা সম্পর্কে নানান কাহিনী প্রচলিত আছে।

সময়কাল

প্রতিবছর আশ্বিন মাসের শুক্লাপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত ৫ দিন ধরে দেবীর পূজা করা হয়। এই পাঁচটি দিন মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী এবং বিজয়া দশমী। ষষ্ঠীর দিন করা হয় দেবীর বোধন এবং বিজয়া দশমীর দিন দেবীর বিসর্জন দেওয়া হয়।

উৎসবের আনন্দ:

এই উৎসব মানে না ধনী ও দরিদ্রের কোনো বিভেদ, জানে না জাতি-ধর্মের ফারাক। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে, ধনী-গরিব নির্বিশেষে মা আসেন সবার ঘরে ঘরে ৫ দিনের অতিথি হয়ে। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে মণ্ডপে মন্দিরে আনন্দঘন আবেগায়িত সময় অতিবাহিত করে। মণ্ডপের ঢাক, কাঁসর, উলুধ্বনি, ধূপ ধুনোর গন্ধ মনটাকে পূজার আনন্দে মতিয়ে তোলে। এই সময় অফিস, বিদ্যালয়, আদালত, সবকিছু বন্ধ থাকে। এবং যারা কাজ বা পড়াশোনার সূত্রে পরিবার থেকে দূরে বা বিদেশে থাকে তারা পরিবারের সাথে পূজার আনন্দে মেতে উঠে। ব্যয়বহুল দুর্গাপূজা সাধারণত অভিজাত সম্প্রদায় উচ্চবিত্ত বাড়িতে এই পূজার আয়াজন করা হয়। উৎসবের আবেগে সকল অর্থনৈতিক ভেদাভেদ দূরে ফেলে সবাই মিলেমিশে পরম আনন্দে প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আর এখানেই বাঙালির দুর্গাপূজা সার্থকতা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *