প্রকৃতি মায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ দানের মধ্যে অন্যতম দান গাছ। মানুষের আবির্ভাবের বহু কাল আগে থেকেই গাছ পৃথিবীর বাসিন্দা। মানুষের জীবনকে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে অগণিত সুবিধা দিয়ে থাকে গাছেরা। গাছ আমাদের বন্ধু – গাছেদের অবদান মানুষের জীবনে অনস্বীকার্য এবং গাছ ছাড়া এই পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব। এজন্য গাছেদেরকে মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু বলা হয়ে থাকে।
গাছের উপকারিতা:
পরিবেশের ওপর গাছের ভূমিকা:
পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে গাছ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গাছ তার সবুজ পাতায় সূর্যালোকের সাহায্যে খাদ্য তৈরি করার সময় উৎপন্ন করে অক্সিজেন এবং এই প্রক্রিয়া চলাকালীন গাছ পরিবেশ থেকে শোষণ করে কার্বন ডাই অক্সাইড নামক গ্যাস।
গাছ কতৃর্ক ত্যাগ করা এই অক্সিজেন শোষণ করেই প্রাণীকুল জীবন ধারণ করে এবং প্রাণীদের ত্যাগ করা বিষাক্ত গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড গাছেরা শোষণ করে পরিবেশকে নির্মল রাখতে সাহায্য করে। এই উপকারিতার জন্য গাছেদেরকে ‘পৃথিবীর ফুসফুস‘ বলা হয়ে থাকে।
জলচক্রের ওপর গাছের ভূমিকা:
জলচক্রের ভারসাম্য বজায় রাখতেই গাছ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গাছেরা তাদের শিকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে জল শোষণ করে। গাছেরা খাদ্য তৈরি সময় এই জলকে পরিবেশে জলীয় বাষ্প রূপে মুক্ত করে। গাছ কর্তৃক ত্যাগ করা এই জলীয় বাষ্প-ই পরবর্তীকালে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বৃষ্টি আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।
এইভাবে গাছ শিকড়ের মাধ্যমে জল তোলার দ্বারা মাটির শুষ্কতা প্রতিরোধ করে এবং মৃত্তিকা ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে।।
পরিবেশকে নির্মল রাখতে বনাঞ্চলও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে গাছ গ্লোবাল ওয়ার্মিং-ও প্রতিহত করতে সাহায্য করে।
মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর গাছের প্রভাব:
মানুষের মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্যের ওপরে গাছের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব আছে। গাছ পরিবেশ দূষণ কমাতে সাহায্য করে – গাছ না থাকলে মানুষ বিভিন্ন রকম দূষণে আরও বেশি আক্রান্ত হত। গাছ সূর্যের থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি এর ক্ষতিকর প্রভাব কমাতেও সাহায্য করে।
আরও পড়ুন – প্রতিবেদন রচনা – রক্তদান শিবির
এমনকি কিছু কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এও প্রমাণিত হয়েছে যে গাছ উৎকণ্ঠা, পীড়ন ইত্যাদি কমিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতেও সাহায্য করে।
মানুষের বন্ধু গাছের সংকট
কিন্তু গাছের এত উপকারীতা থাকা সত্বেও মানুষ অবিবেচকের মত প্রতিনিয়ত গাছ কেটেই চলেছে। বৃক্ষচ্ছেদন আজকের পৃথিবীর কাছে এক মারাত্মক অভিশাপ।
বৃক্ষচ্ছেদনের কারণ
বৃক্ষচ্ছেদন সম্পর্কিত যেসব বিভিন্ন গবেষণা সংগঠিত হয়েছে তাতে নানান ভয়ংকর তথ্য সামনে উঠে এসেছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড এর একটি গবেষণা অনুযায়ী প্রতিবছর প্রায় ১.৮ কোটি একর এর মত গাছ কাটা হয়।
আর এত বৃক্ষচ্ছেদনের মূলে আছে মানুষ এবং তার ক্রিয়াকলাপ – যেমন: কাঠ কাটা, ফসল এবং শস্য উৎপাদনের জন্য কৃষিজমি তৈরি ইত্যাদি।
তবে শুধুমাত্র যে মানুষই গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার জন্য দায়ী এমনটা নয়। ভিন্ন প্রাকৃতিক কারণেও গাছেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বন ধ্বংস হয়। এর মধ্যে অন্যতম কারণটি হল দাবানল। তবে মানুষের ক্রিয়াকলাপের ফলে যেভাবে অরণ্য ধ্বংস হচ্ছে তা সত্যিই ভাবার বিষয়।
নগরায়ণ
বৃক্ষচ্ছেদনের অন্যতম মূল কারণ নগরায়ণ। কংক্রিটের ঘরবাড়ি গড়ে তুলে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য, রাস্তাঘাট নির্মাণ করে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নততর করার জন্য প্রতিনিয়ত মাইলের পর মাইল গাছ কাটা হচ্ছে। শুধুমাত্র নতুন নগর-শহর গড়ে তোলাই নয় – শহরের বিস্তারের জন্য ব্যাপক পরিমাণে গাছ কাটা হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত।
কিন্তু এই বৃক্ষচ্ছেদনের জন্য শুধু যে গাছেদের ক্ষতি হচ্ছে তা একদম নয় – গাছ ছাড়াও বৃক্ষচ্ছেদনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ সহ সমগ্র প্রাণীকূল।
বৃক্ষচ্ছেদনের ফল
গাছ কেটে ধ্বংস করার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমগ্র বাস্তুতন্ত্র, এতে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেইসব প্রাণীরা যারা গাছেদের ওপর সরাসরি নির্ভর করে বেঁচে থাকে। তৃণভোজী প্রাণীরা খাদ্যের সংকটে ভুগছে। খাবারের অভাবের জন্য এই সকল তৃণভোজী প্রাণীরা নিজেদের বাসস্থান ছেড়ে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে। তৃণভোজী প্রাণীদের উপর নির্ভর করে থাকা মাংসাশী প্রাণীরাও এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিজস্ব স্বাভাবিক বাসস্থানে তৃণভোজী প্রাণীদের অভাবের জন্য মাংসাশী প্রাণীরাও খাদ্য সংকটে পড়ছে।
শুধুমাত্র বৃক্ষচ্ছেদনের জন্যই যে গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তা নয়। ক্রমাগত বদলাতে থাকা পরিবেশের প্রভাবে বিভিন্ন ক্ষতিকারক কীট-পতঙ্গের উৎপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের গাছেরা। এইসব কীট-পতঙ্গেরা গাছের পাতা খেয়ে অন্যান্য বিভিন্ন পদ্ধতিতে গাছের প্রভূত ক্ষতিসাধন করছে, যার ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে গাছেরা মারাও যাচ্ছে।
গাছ আমাদের বন্ধু – উপসংহার
আমাদের বেঁচে থাকার জন্য গাছ অপরিহার্য – গাছেদের ছাড়া আমাদের জীবন ধারণ কোনমতেই সম্ভব নয়। গাছ ছাড়া মানুষের যা অবস্থা হবে তা কল্পনা করাই আতঙ্কের বিষয়।
কিন্তু এত কিছু জানা সত্ত্বেও মানুষ প্রতিনিয়ত গাছ কেটেই চলেছে। মানুষের এই ভুলের ফল আমরা ইতিমধ্যেই ভোগ করছি। পরিবেশে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া বা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়া গাছ কাটারই পরিণাম। গাছ ছাড়া আমাদের পৃথিবীতে কোন বাস্তুতন্ত্র থাকবে না। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা ধরণী পরিণত হবে ধুধু মরুভূমিতে।
গাছ আমাদের বন্ধু – তাই নিজেদের কথা চিন্তা করে, অন্তত আমাদের নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই বাঁচিয়ে রাখতে হবে গাছেদেরকে। শপথ করতে হবে – অকারণে গাছ কাটা যাবে না। একান্ত প্রয়োজনে গাছ কাটতেই হলে নতুন চারা গাছ রোপন করতে হবে। শুধুমাত্র রোপন করলেই হবে না – সেই নতুন চারা গাছের যত্ন নিতে হবে খেয়াল রাখতে হবে তারা যেন ঠিকমতো বড় হয়ে ওঠে। পরিবেশ দিবস পালন, অরণ্য সপ্তাহ উদযাপন করে মানুষের মধ্যে গাছেদেরকে নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, তবেই মানুষের বন্ধু।
ধন্যবাদ