গৌণ কোষ হল এমন এক ধরনের তড়িৎ-রাসায়নিক কোষ যেখানে রাসায়নিক শক্তি তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
এই ধরনের কোষকে গৌণকোষ বলে কেন? গৌণকোষ নামকরণের তাৎপর্য
এই ধরনের কোশে তড়িৎ শক্তি উৎপাদন করার জন্য যেহেতু বাইরে থেকে তড়িৎ শক্তির প্রয়োগ করতে হয়, তাই এই ধরনের কোশকে গৌণ কোষ বলে।
গৌণ কোশের কর্মদক্ষতা শেষ হয়ে গেলে আবার তরিতাহিত করেন করে এদেরকে পুনরায় ব্যবহার করা যায়। তাই এদেরকে rechargeable cell বলা হয়।
গৌণ কোষের আবিষ্কার
ফরাসি বিজ্ঞানী গ্যাস্তন প্লাঁতে, ১৮৫৯ সালে প্রথম গৌণ কোশ আবিষ্কার করেন। সালফিউরিক অ্যাসিডের মধ্যে দুটি তড়িৎদ্বার নিমজ্জিত করে তিনি এই কোষ তৈরি করেন।
প্লাঁতে পর্যবেক্ষণ করেন যে প্রবাহী তড়িৎ – এর সাহায্যে এই ধরনের কোশ কে আহিত করলে তড়িৎদ্বারের লেড সালফেটকে পুনরায় লেড ধাতু এবং লেড ধাতুর অক্সাইডে পরিবর্তন করা সম্ভব – এই ধারণার উপর ভিত্তি করি পরবর্তীকালে গৌণ কোষ তৈরি করা শুরু হয়।
গৌণ কোষের প্রকারভেদ:
প্রাথমিক কোশের মতই গৌণ কোষও বিভিন্ন প্রকারের হয়। যেমন : লেড অ্যাসিড সঞ্চায়ক কোষ, নিকেল ক্যাডমিয়াম ব্যাটারি ইত্যাদি।
লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোশ (কোষ):
লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোশ হল সবথেকে প্রাচীনতম এবং সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত গৌণ কোশ। এমনকি এটি সবথেকে বহুল ব্যবহৃত প্রাথমিক কোশও বটে। নিচে লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোষ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল:
লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোশ আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী গ্যাস্তন প্লাঁতে।
লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোশে তড়িৎদ্বার হিসাবে ব্যবহার করা হয় লেড এবং লেড ডাই-অক্সাইড এর দন্ড। লেড ডাই-অক্সাইডকে ধনাত্মক তড়িৎদ্বার বা ক্যাথোড এবং ধাতব লেডকে ঋণাত্মক তড়িৎদ্বার বা অ্যানোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তড়িৎ বিশ্লেষ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় সালফিউরিক অ্যাসিডের লঘু দ্রবণ।
লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোশের তড়িৎচালক বল প্রাথমিক অবস্থায় থাকে ২.২ ভোল্টের কাছাকাছি। অবশ্য কোশটি অল্প সময় ধরে ব্যবহার করার পরেই এই তড়িৎ চালক বলের মান নেমে আসে প্রায় ২ ভোল্ট এর কাছাকাছি। দীর্ঘ সময় ব্যবহারের পর যখন এর কর্মদক্ষতা প্রায় কমে আসে তখন এটি প্রায় ১.৮ ভোল্টের তড়িৎচালক বল সরবরাহ করে। লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোশের একটি সুবিধা হল এটিই যে কোশটির কার্যক্ষমতা পরিমাপের জন্য কোশের অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলিকে না পরীক্ষা করলেও চলে, শুধুমাত্র ভোল্টমিটারের সাহায্যে কোশের তড়িৎচালক বল পরিমাপ করলেই কোশের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোষের সুবিধা
লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোশের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এর অত্যন্ত নিম্নমানের অভ্যন্তরীণ রোধ। অভ্যন্তরীণ রোধের মান খুব কম হওয়ার কারণে এই কোশ নিজের তড়িৎচালক বলের প্রায় সমান বিভবপ্রভেদ বদ্ধ বর্তনীতে সরবরাহ করতে পারে।
নিচে লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোষের আরও কতকগুলো সুবিধা তুলে ধরা হল:
১. লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোষগুলি দামে সস্তা।
২. লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোষের উপাদান গুলি সহজলভ্য।
৩. লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোশ তাদের আয়তনের বিচারে অন্যান্য কোশের থেকে বেশি ক্ষমতা সরবরাহ করতে পারে।
লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোষের অসুবিধা
এতগুলি সুবিধা থাকা সত্ত্বেও, লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোশের কিছু ব্যবহারিক অসুবিধাও রয়েছে, নিচে সেগুলি তুলে ধরা হল:
১. লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোশগুলির ওজন (ভর) তুলনামূলকভাবে বেশ বেশি।
২. লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোশ তৈরিতে এমন কিছু উপাদান ব্যবহার করা হয় যা মানুষের শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই কোশটিতে ব্যবহৃত অন্যতম প্রধান উপাদান লেড শরীরে গেলে বিভিন্ন ধরনের রোগ দেখা দেয়।
লিথিয়াম আয়ন কোশ
লিথিয়াম আয়ন কোশ হল এমন এক ধরনের গৌণ কোষ যেখানে লিথিয়ামের তৈরি ক্যাথোড ব্যবহার করা হয়।
এই ধরনের কোশের ক্যাথোড হিসেবে ব্যবহার করা হয় লিথিয়াম কোবাল্ট অক্সাইড এবং অ্যানোড হিসেবে ব্যবহার করা হয় গ্রাফাইট। তবে, তড়িৎ বিশ্লেষ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয় অ-জলীও তড়িৎ বিশ্লেষ্য।
লিথিয়ামের তৈরি প্রাথমিক কোশের মত লিথিয়ামের তৈরি গৌণ কোষের অভ্যন্তরীণ ঘনত্ব বেশ বেশি হয়। এজন্য লিথিয়ামের তৈরি গৌণকোষে আরো বেশি পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত থাকতে পারে।
উল্লেখ্য, লিথিয়াম কোশ এবং লিথিয়াম আয়ন কোশ পরস্পর আলাদা।
লিথিয়াম আয়ন কোষের সুবিধা
লিথিয়ামের তৈরি প্রাথমিক কোশের বেশ কিছু সুবিধা আছে, যেমন:
১. লিথিয়ামের তৈরি প্রাথমিক কোশের শক্তি ঘনত্ব বেশি হওয়ায় এটি বেশি পরিমাণ শক্তি সরবরাহ করতে পারে।
২. লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোশের মত এই কোশে কোন বিষাক্ত পদার্থ থাকে না।
৩. এই কোশের জীবনকালও লেড অ্যাসিড সঞ্চয়ক কোশের তুলনায় বেশি হয়।
লিথিয়াম আয়ন কোষের অসুবিধা
আবার এই কোষেরও কিছু অসুবিধা রয়েছে-
১. লিথিয়াম আয়ন কোশের প্রধান অসুবিধা হল, এটি অন্যান্য গৌণ কোষের তুলনায় বেশি দামি।
২. প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পরিমাণে আহিত করা হয়ে গেলে লিথিয়াম আয়ন কোশ পুড়ে যেতে পারে বা আগুন ধরে যেতে পারে।
গৌণ কোশের সুবিধা
প্রাথমিক কোষের তুলনায় গৌণ কোশের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে।
ব্যবহার
১. প্রাথমিক কোশ শুধুমাত্র একবার ব্যবহার করা যায়। একবার কর্মদক্ষতা শেষ হয়ে গেলে এই কোশকে আর পুনরায় ব্যবহার করা যায় না, ফেলে দিতে হয়। কিন্তু, একবার গৌণ কোশের কার্যক্ষমতা শেষ হয়ে গেলে আহিতকরণের মাধ্যমে তা আবার ব্যবহার করা যায়।
পরিবেশের ওপর প্রভাব
২. যেহেতু গৌণ কোশ একবার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হয় না তাই গৌণ কোষের প্রভাবে পরিবেশ দূষণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়।
মূল্য
৩. প্রাথমিক ব্যায় বেশি হলেও গৌণ কোশ যেহেতু বহুবার ব্যবহার করা যায়, তাই এটি প্রাথমিক কোশের তুলনায় সাশ্রয়ী।