এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় – অতিরিক্ত ভৌম জল উত্তোলনের প্রভাব।
ভৌম কথাটি ভূমি শব্দ থেকে উৎপন্ন হয়েছে, ভূমি শব্দটির অর্থ হল মাটি। অর্থাৎ মাটির অভ্যন্তরে জল পাওয়া যায়, তাকে ভৌম জল বলা হয়ে থাকে।
আরও ভালো ভালো করে বলতে গেলে, ভূপৃষ্ঠের নিচে রেগোলিথ স্তরে, নুরি বালি ইত্যাদি শিলার মধ্যে যে জল পাওয়া যায় তাকে ভৌম জল বলা হয়।
মানুষের জীবনে ভৌম জলের গুরুত্ব অপরিসীম। সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন সকল উৎসের জল ব্যবহার করে তার মধ্যে ভৌম জল অন্যতম, বলা বাহুল্য – প্রধান।
কিন্তু প্রত্যহ মানুষের এই ব্যাপক জলের চাহিদার জন্য মানুষ মাটির অভ্যন্তর থেকে ব্যাপক পরিমাণে জল তুলে নিচ্ছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত এত বেশি পরিমাণে জল তুলে নেওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত ক্ষতি হচ্ছে মানুষেরই।
নিম্নে অতিরিক্ত ভৌম জল উত্তোলনের প্রভাব সংক্ষেপে আলোচনা করা হল –
১) অতিরিক্ত ভৌম জল উত্তোলনের প্রভাব : ভৌম জলস্তর এর অবনমন:
প্রতিনিয়ত মাটির নিচে থেকে ব্যাপক পরিমাণে জল তুলে নেওয়ার কারণে ভৌম জলের স্বাভাবিক স্তরের অবনমন ঘটছে। অর্থাৎ ভৌম জল স্তর আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। অপরদিকে, আধুনিক যুগে বিভিন্ন স্থানে নির্মাণকার্য হওয়ার জন্য সেই সব স্থানে মাটির ওপরে জল (যেমন বৃষ্টির জল) মাটির নিচের চুইয়ে পৌঁছাতে পারছে না। এর ফলে ভৌম জলস্তর এর ঘাটতি পূরণ হতে পারছে না, ফলে ভৌম জলস্তর এর অবলম্বন করছে।
Table of Contents
Toggle২) অতিরিক্ত ভৌম জল উত্তোলনের প্রভাব : পানীয় জল সংকট:
মানুষের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য উপাদান পানীয় জল – এজন্যই জলকে জীবন বলা হয়ে থাকে। ভৌম জল হল মানুষের পানীয় জলের প্রধানতম উৎস। প্রতিনিয়ত ভৌম জল স্তর কমে যাওয়ার কারণে ভৌম জলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে এজন্য অদূর ভবিষ্যতে ভৌম জলের অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের পানীয় জলের সংকট এর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
আরও পড়ুন : বনভূমি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
৩) অতিরিক্ত ভৌম জল উত্তোলনের প্রভাব : ভূমিস্তরের অবনমন:
মাটির নিচে রেগোলিথ স্তরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকে যার মধ্যে ভৌম জল অবস্থান করে। যথেষ্ট পরিমাণ ভৌম জল মাটির নিচে থাকলে এই স্তরে জলের কারণে চাপের সাম্য বজায় থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত ভ্রমণ উত্তোলনের প্রভাবে শিলার এইসব সুক্ষ সুক্ষ ছিদ্রে ভৌম জল প্রবেশ করতে পারছে না, ফলতঃ কিছু কিছু স্থানে হঠাৎ ভূমি অবনমনের আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন অদূর ভবিষ্যতে কলকাতা শহরে এরকম ভূমি অবনমন দেখা যেতে পারে।
মাটির লবণতা বৃদ্ধি:
মাটির তলা থেকে অতিরিক্ত ভৌম জল তুলে নেওয়ার ফলে ভূগর্ভে সঞ্চিত বিভিন্ন প্রকার ক্লোরাইড, ফ্লুরাইড, নাইট্রাইট জাতীয় লবণ জলের সঙ্গে মিশে মাটির ওপর উঠে আসছে। এতে মাটির উপরে লবণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে যার ফলে উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে।
কৃষি জমিতে নলকূপের সাহায্যে জল তোলার সময় এই সমস্ত লবণ জলের সঙ্গে উঠে আসছে এবং কৃষি জমিতে লবণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে কৃষি জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে।
সেচের জলের অভাব:
অতিরিক্ত ভৌম জল উত্তোলনের ফলে বর্তমানে সেচ কার্যের জন্য প্রয়োজনীয় জলের অভাব দেখা দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের একটি তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে মোট সেচ কাজের প্রায় ৭০% ভূগর্ভস্থ জলের সাহায্যে করা হয়।
প্রতিদিন এত বিপুল পরিমান জল তুলে নেওয়ার জন্য ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এর ফলে শেষ কার্যের জন্য প্রয়োজনীয় জলের অভাব দেখা যাবে।
রোগ সৃষ্টি:
মাটির তলা থেকে অতিরিক্ত ভৌম জল তুলে নেওয়ার জন্য আর্সেনিক, ফ্লুরাইড উনাইটেড জাতীয় ক্ষতিকর পদার্থ গুলি মাটির ওপরে উঠে আসছে। বাতাসে অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে বিভিন্ন যৌগ তৈরি করছে যা মানবদেহের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। আর্সেনিক বাতাসে অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে আর্সেনাইট নামক যৌগ তৈরি করে জলের সঙ্গে মিশে আমাদের দেহে নানান রোগের সৃষ্টি করে।
আর্সেনিকযুক্ত জল দীর্ঘদিন ধরে পান করলে চামড়ার বিভিন্ন রোগ দেখা যায়। এমনকি আর্সেনিক দূষণের ফলে ঘটিত ব্ল্যাক ফুট রোগ কখনো কখনো ক্যান্সার রোগেও পরিণত হয়। অতিরিক্ত ভৌম জল উত্তোলনের প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ জেলায় আর্সেনিক দূষণের কবলে এবং সেইসব বসবাসকারী বিভিন্ন মানুষ আজ আর্সেনিক দূষণের শিকার।
পানীয় জলে সামান্য মাত্রায় ফ্লুরাইড থাকা আমাদের দাঁত এবং হাড়ের পক্ষে ভালো। কিন্তু অতিরিক্ত ভৌম জল উত্তোলনের প্রভাবে বেশিমাত্রায় ফ্লুরাইড জলের মধ্য দিয়ে উঠে আসছে। অতিরিক্ত ফ্লোরাইডযুক্ত দীর্ঘদিন ধরে খাওয়ার ফলে দাঁত এবং হাড়ের বিভিন্ন রোগ দেখা দিচ্ছে। পুরুলিয়া সহ পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিকের বিভিন্ন জেলার বহু মানুষ আজ ফ্লুরাইড দূষণের শিকার।