ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কন্ঠের অধিকারী সঙ্গীত শিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ই জুন বেনারসে জন্মগ্রহণ করেন।
বাংলা ও হিন্দি ছাড়াও মারাঠি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি অসমীয়া, সংস্কৃত ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষায় গান করেন সঙ্গীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। প্রথম জীবনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়লেও গানের টানে ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে সঙ্গীত জগতে আসেন তিনি। বন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে রেডিওতে গান করার ব্যবস্থা করে দেন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথম যে ছবিতে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তার নাম নিমাই সন্ন্যাস (১৯৪১)। ১৯৪৩ সালে প্রথম নিজের সুরে ৩ টি গান রেকর্ড করেন হেমন্ত।
বাংলা গানের ইতিহাসে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান হল উচ্চারণ এর বিশুদ্ধিকরণ। যে বিষয়টি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য গায়ক থেকে পৃথক করে তোলে, তা হল তাঁর বিশুদ্ধ এবং পরিশীলিত উচ্চারণ। বাংলা গানে উচ্চারণের যে ‘সাবেকিয়ানা’ চলে আসছিল, তা থেকে বাংলা গানকে তিনি গানকে মুক্ত করেন।
রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী হিসাবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অবদান:
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে রবীন্দ্র সংগীতের সর্বকালের সেরা শিল্পী হিসেবে মনে করা হয়। ১৯৪৪ সালে ‘প্রিয় বান্ধবী‘ ছবিটির জন্য প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, গানটি ছিল – ‘আমার আর হবে না দেরি‘।
আরও পড়ুন – বাংলা গানের ইতিহাসে মান্না দের অবদান
জীবনে প্রায় দুই সহস্রাধিক রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বেসিক রেকর্ড ছাড়াও বহু সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
সিনেমা এবং বেসিক রেকর্ড মিলিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সবথেকে জনপ্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীতের তালিকা নিচে তুলে ধরা হল –
- তুমি রবে নীরবে
- চরণে ধরিতে দিয়োগো আমারে
- দিনের শেষে ঘুমের দেশে
- তুমি কী কেবলই ছবি
- যৌবনসরসীনীরে
- এই করেছো ভালো নিঠুর হে
- আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি
- নীরব করে দাও হে তোমার
- তাই তোমার আনন্দ আমার পর
- আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
- পুরনো সেই দিনের কথা
- কি গাবো আমি কি শুনাব
- জীবন যখন শুকায়ে যায়
- জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে
নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসাবে বাংলা সিনেমার গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অবদান
রবীন্দ্র সঙ্গীতের মতোই হেমন্ত সমধিক জনপ্রিয় ছিলেন সিনেমার নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে। বাংলা ও হিন্দি উভয় ভাষাতে অগুণিত গান গেয়েছেন তিনি।
১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়া শাপমোচন ছবিতে উত্তম কুমারের নেপথ্য কন্ঠ হিসাবে প্রথম পাওয়া যায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। এই সিনেমার বসে আছি পথ চেয়ে, ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস, সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা ও শোনো বন্ধু শোনো প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা – এই চারটি গান দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। সেখান থেকেই উত্তম-হেমন্তের নায়ক-গায়ক জুটির যাত্রা শুরু। ১৯৫৯ সালের দ্বীপ জেলে যাই ছায়াছবিতে তাঁর গাওয়া এই রাত তোমার আমার এবং ১৯৬১ সালের সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সপ্তপদী ছায়াছবির এই পথ যদি না শেষ হয় গানদুটিকে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম সেরা দুটি গান হিসাবে গণ্য করা হয়।
উত্তম কুমার ছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তাপস পাল, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বহু নায়কের লিপে গান গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
এখানে (রবীন্দ্র সঙ্গীত ব্যাতিত) বাংলা সিনেমায় নেপথ্য কণ্ঠে গাওয়া তাঁর সেরা গানগুলির তালিকা তুলে ধরা হল –
- এই রাত তোমার আমার
- এই পথ যদি না শেষ হয়
- এই মেঘলা দিনে একলা
- সূর্য ডোবার পালা
- মুছে যাওয়া দিনগুলি
- নীর ছোট ক্ষতি নেই
- চঞ্চল মন আনমনা হয়
- আজ দুজনার দুটি পথ
- কে যেনো গো ডেকেছে আমায়
- কেন দূরে থাকো
বাংলা গানের ধারায় সলিল চৌধুরি-হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অবদান
কিংবদন্তি গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরীর সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জুটি জনমানসে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৪৭ সালে গাঁয়ের বধূ গানটির মধ্য দিয়ে এই জুটির যাত্রা শুরু। এরপর সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে বহু গান রেকর্ড করেন হেমন্ত। এর বেশিরভাগ ছিল বেসিক রেকর্ডের।
রানার, পালকির গান – ইতাদি গানের মধ্যে দিয়ে বাংলা গানের ইতিহাসে এক নতুন যুগ শুরু করলেন সলিল চৌধুরি এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। উল্ল্যেখ্য, বাংলা গানের ইতিহাসে এর আগে ‘রানার’, ‘ধিতাং ধিতাং বলে’ বা ‘পালকির গান’ এর মত সুর কোনো সুরকার সৃষ্টি করেননি করেননি – সলিল চৌধুরিই প্রথম এমন ব্যতিক্রমী সুর সৃষ্টি করলেন, গাইলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
হেমন্ত ও সলিল জুটির জনপ্রিয় কিছু গান হল –
- আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা
- রানার (কথা: সুকান্ত ভট্টাচার্য)
- দুরন্ত ঘূর্ণির এই লাগছে পাক
- পথ হারানো বলেই এবার
- শোনো কোনো একদিন
- গাঁয়ের বধূ
- অবার পৃথিবী (কথা: সুকান্ত ভট্টাচার্য)
- পালকির গান
- মনের জানালা ধরে
বাংলা ভাষা ছাড়াও হিন্দি ভাষাতেও বহু গান রেকর্ড করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় – এর বেশিরভাগই ছিল ছায়াছবির (সিনেমার) গান। সিংহভাগ গানই জনমানসে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এখানে যেহেতু বাংলা গানের ধারায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অবদান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তাই হিন্দি গানের প্রসঙ্গ বাদ রাখা হল।