Table of Contents
ভূমিকা:
আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যে কয়েকটি অত্যাবশ্যকীয় জিনিস প্রয়োজন, জল তার মধ্যে অন্যতম। জল ছাড়া মানবদেহ বেঁচে থাকতে পারে না, মানুষের দেহে জল অত্যাবশ্যকীয় বলেই বলা হয়ে থাকে জলই জীবন।
পৃথিবীতে জলের কোনো অভাব নেই। মোট পৃথিবীপৃষ্ঠের ৪ ভাগের প্রায় ৩ ভাগ জলে ঢাকা, যেখানে মাত্র ১ ভাগ অংশে স্থল বিরাজমান।
বলা বাহুল্য, সব ধরনের জল কে আমরা সমানভাবে ব্যবহার করতে পারি না। কিছু কিছু উৎসের জল (খাল, নর্দমা) একেবারেই ব্যবহারের অনুপযুক্ত আবার কিছু কিছু উৎস থেকে পাওয়া জল (নলকূপ, কুয়ো) আমরা প্রত্যহ ব্যবহার করে থাকি। একনজরে দেখে নেওয়া যাক পৃথিবীতে সঞ্চিত মোট জলের হিসাব-নিকাশ –
পৃথিবীতে সঞ্চিত মোট জলের হিসাব নিকাশ :
পৃথিবীতে ব্যাপক পরিমাণে জল থাকলেও সেই জলের সিংহভাগই সমুদ্রের জল। কিন্তু সমুদ্রের জলে লবণের পরিমাণ এত বেশি থাকে যে তারা সাধারণ মানুষের প্রত্যহ কাজ কর্মের অনুপযুক্ত। পৃথিবীর মোট সঞ্চিত জলের প্রায় ৯৮% জল হল সমুদ্রের লবণাক্ত জল।
বাকি ২ % জল আমাদের ব্যবহার উপযোগী স্বাদু জল। আবার এই জলের বেশিরভাগটাই আমরা ব্যবহার করতে পারি না কারণ, মোট স্বাদু জলের প্রায় ৮৭% হিমবাহ বা বিভিন্ন উৎসের মধ্যে বরফ হিসেবে সঞ্চিত থাকে। মোট স্বাদু জলের মাত্র ১২% ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে রয়েছে, যাকে আমরা ভৌম জল বলে থাকি। নদী, খাল-বিল ইত্যাদি উৎসে যে পরিমাণ জমিতে থাকে তার পরিমাণ মোট স্বাদু জলের মাত্র ১%।
জল সংরক্ষণ কেন গুরুত্বপূর্ণ :
অতএব এই হিসাব-নিকাশ থেকে বোঝা গেল আমাদের পৃথিবীতে প্রচুর পরিমাণে জল থাকলেও সেই জলের খুব কম অংশই ব্যবহারের উপযুক্ত। আবার ব্যবহারের উপযুক্ত জলের কিয়দংশই সহজলভ্য যা আমরা সরাসরি ব্যবহার করতে পারি।
প্রত্যহ মানুষের নানাবিধ কাজকর্মের ফলে এই স্বাদু জলের ভান্ডার ব্যাপকভাবে দূষিত হচ্ছে। নিচে আমাদের ব্যবহারযোগ্য জল প্রতিনিয়ত কীভাবে দূষিত হচ্ছে তা তুলে ধরা হল –
জল দূষণের কারণ হিসাবে দৈনন্দিন কাজের ফলে উৎপন্ন বর্জ্য:
মানুষের দৈনন্দিন নানাবিধ কাজের ফলে প্রতিনিয়ত বহু বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন হয়। শহরে বা যেসব স্থানে জল নিকাশি ব্যবস্থা থাকে সেখানে এইসব উৎপন্ন বর্জ্য পদার্থ সরাসরি নালা নর্দমার মাধ্যমে চলে যায় নদী বা বড় কোন জলাশয়ে। এই নোংরা বর্জ্য নদী বা ওই জলাশয় জলে মিশে জলাশয়গুলোর জল দূষণ ঘটায়।
উল্লেখ্য বিভিন্ন প্রকার শোধনাগার এর মাধ্যমে এরূপ জলকে শোধন করা যায়। শোধন করা জলে বর্জ্যের পরিমাণ অনেকটাই কমে যায় এবং জলকে তুলনামূলকভাবে পরিশ্রুত করে তারপর জলাশয় নিক্ষেপ করা যায়।
দৈনন্দিন যেসব বর্জ্য পদার্থ জলাশয় নিক্ষেপ করা হয় তাদের মধ্যে সবথেকে ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থ হল প্লাস্টিক ও পলিথিন জাতীয় বর্জ্য পদার্থ। এগুলি কখনোই জলের সঙ্গে মিশে যায় না। বরং জলের মধ্যে থেকে মাঝে মাঝে নালা-নর্দমার মুখ আটকে দেয়, যার ফলে জল নিকাশি ব্যবস্থা ব্যাহত হয়।
এইসব প্লাস্টিক ও পলিথিন জাতীয় পদার্থ জলে মিশলে তা জলজ প্রাণীদের জীবনহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জলচর প্রাণীরা প্লাস্টিক ও পলিথিন জাতীয় পদার্থ খাওয়ায় মৃত্যুর সম্মুখীন হয়।
জল দূষণের কারণ হিসাবে কলকারখানা থেকে উৎপন্ন বর্জ্য:
কলকারখানার বর্জ্য পদার্থের অন্যতম উৎস। বিভিন্ন রকম কারখানা থেকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রকম বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন হয়। কারখানা থেকে যে সব ধরনের বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন হয় তাদেরকে মূলত ৩ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে –
- কঠিন বর্জ্য
- তরল বর্জ্য
- গ্যাসীয় বর্জ্য
কারখানা থেকে উৎপন্ন কঠিন বর্জ্য গুলিকে সাধারণত নির্দিষ্ট স্থানে স্তুপকৃত করে রাখা হয় এবং গ্যাসীয় বর্জ্য গুলি সরাসরি বায়ুতে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু, তরল বর্জ্য নিক্ষেপ করা হয় নদী সহ বিভিন্ন প্রকার জলাশয়ে।
সম্পর্কিত নিবন্ধ : ভৌম জলের অতিরিক্ত ব্যবহারের প্রভাব
তরল বর্জ্য:
কলকারখানা থেকে উৎপন্ন তরল বর্জ্য পদার্থকে ছোটো খাল বা নালার মাধ্যমে বড়ো কোন জলাশয় বা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়: গঙ্গা নদীর গতিপথে গঙ্গার দুই দিকে প্রচুর পরিমাণ কলকারখানা দেখা যায়। এই কল কারখানা থেকে উৎপন্ন দূষিত বর্জ্য পদার্থ সরাসরি গঙ্গার জলে নিক্ষেপ করা হয়। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী: গঙ্গায় মোট নিক্ষেপিত বর্জ্যের প্রায় ১২% বর্জ্য কল কারখানাজাত বর্জ্য পদার্থ।
এইসব বর্জ্য গুলি সাধারণত দূষিত প্রকৃতির হওয়াই তা জলে মিশে জলজ প্রাণীদের জীবনকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানবসমাজ কেউ তা ক্ষতিগ্রস্ত করে।
তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ:
কিছু কিছু শিল্প কেন্দ্র এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ গুলি মাটির নিচে সুরক্ষিত ভাবে গ্রথিত করে রেখে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই সব তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ মাটির মধ্যে থাকতে থাকতে ভৌম জলের সংস্পর্শে চলে আসে। ভৌম জলের সঙ্গে মিশে এইসব তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ মারাত্মক জল দূষণ ঘটায়।
আরও পড়ুন : ভারতের জলবায়ুর নিয়ন্ত্রক
জল দূষণের কারণ হিসেবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র:
পারমাণবিক বিদ্যুৎ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বিভিন্ন উপায়ে জল দূষণ ঘটায়।
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে তাপ শক্তি উৎপাদনের সময় কয়লার সাহায্যে জল ফুটিয়ে স্টিম উৎপন্ন করা হয়। এই বাষ্প কয়েকবার ব্যবহার করার পর তা কাছাকাছি কোন নদী বা জলাশয় ফেলে দেওয়া হয়। এই উত্তপ্ত স্টিম / বাষ্প জলাশয়ে মিশে জলাশয় এর স্বাভাবিক তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং জল দূষণ ঘটে।
জল দূষণের কারণ হিসাবে কৃষিক্ষেত্র থেকে উৎপন্ন বর্জ্য:
জলাশয় জল দূষণের পিছনে কৃষিক্ষেত্রের ভূমিকাও কম নয়। প্রতিদিন কৃষিক্ষেত্র থেকে এমন বিভিন্ন পদার্থ উৎপন্ন হয়, যা জলে মিশে জল দূষণ ঘটায় এবং জলের গুণগত মান কমিয়ে দেয়।
রাসায়নিক পদার্থ, বিষতেল:
কৃষি ক্ষেত্রে পোকামাকড় মারার জন্য বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক পদার্থ, বিষতেল ব্যবহার করা হয়; বৃষ্টির জলে এইসব রাসায়নিক পদার্থ ও বিষতেল ধুয়ে নদী-খাল-বিল ইত্যাদির জলে মিশে জল দূষণ ঘটায়।
সার:
ফসল ফলানোর জন্য যেসব সার ব্যবহার করা হয় সেই সব জৈব ও অজৈব সার জলাশয় জলে মিশে জলে খাদ্য উপাদান বহুল পরিমাণে বাড়িয়ে দেয়। জলাশয় এইভাবে খাদ্য-উপাদান বেড়ে গেলে ইউট্রোফিকেশন এর মত ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।
জল দূষণের কারণ হিসাবে খনিজ তেল:
জাহাজে করে পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থ সমূহ এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার সময় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে জাহাজে থাকা হাজার হাজার লিটার খনিজ তেল / পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থ সমুদ্র জলের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়। এই খনিজ তেলের ঘনত্ব জলের ঘনত্বের থেকে কম হওয়ার কারণে সেগুলি জলের ওপর ভাসতে থাকে এবং জলে বসবাসকারী প্রাণীদের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে।
উপসংহার:
এছাড়াও জল দূষণের পিছনে বিভিন্ন কারণে বর্তমান। বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ মিশে যে জল দূষণ ঘটায় তার ফলে যেমন সরাসরি জলচর প্রাণীর ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানব সমাজও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জল দূষণে আক্রান্ত হওয়া বিভিন্ন রকম জলচর প্রাণীদেরকে (যেমন : মাছ) আমরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি। দূষিত জলে বেড়ে ওঠা এইসব প্রাণীগুলিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার ফলে তাদের শরীরের দূষণ সরাসরি মানব শরীরে প্রবেশ করছে।
তাই জল দূষণ আজকের দিনে এক জ্বলন্ত সমস্যা। আমাদের সবারই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে চেষ্টা করা উচিত বিভিন্নভাবে জল দূষণ কম করার।