চন্দ্রযান ৩

১৪ ই জুলাই ২০২৩, দুপুর ২.৩৫ মিনিটে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) চন্দ্রযান ৩ এর সফল উৎক্ষেপন করে। এটি ইসরোর তৃতীয় চন্দ্রাভিযান। ইসরো এর আগে ২০০৯ এবং ২০১৯ সালে যথাক্রমে চন্দ্রযান ১ এবং চন্দ্রযান ২ এর মাধ্যমে চাঁদে পাড়ি দেওয়ার প্রচেষ্টা করেছিল।

চন্দ্রযান ৩ এর মাধ্যমে ভারত চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফ্ট ল্যান্ডিং এ প্রয়াস করবে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করতে পারলে ভারত ২য় দেশ হিসাবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে অবতরণ করার কৃতিত্ব অর্জন করবে। এর আগে চিন একমাত্র দেশ যারা এই কাজে সফলতা অর্জন করেছে।

চন্দ্রযান ৩ এর সম্পূর্ণ অভিযানটি সম্পন্ন করতে খরচ হবে প্রায় ৬১৫ কোটির টাকার কাছাকাছি। এই খরচের মুখ্য অংশটি (৩৬৫ কোটি টাকা) ব্যয়িত হবে রকেটটি উৎক্ষেপণ করার জন্য এবং বাকি ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে চন্দ্রযানের বিভিন্ন সামগ্রী, যেমন – প্রোপালশন মডিউল, ল্যান্ডার এবং রোভার তৈরি করার জন্য।

চন্দ্রযান ৩ এর রকেট

চন্দ্রযান ৩ কে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে GSLV-III রকেটের সাহায্যে। উক্ত রকেটটি ৪ হাজার ৫০০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ভর বহন করতে সক্ষম। রকেটটি প্রায় সাড়ে ৪৩ মিটার (৪৩.৪ মিটার) উচ্চতাবিশিষ্ট এবং এর ব্যাস ৩.২ মিটার।

GSLV-III রকেটের প্রথম স্টেজে দুটি ইঞ্জিন বর্তমান – এই দুটি ইঞ্জিনে জ্বালানি হিসেবে যথাক্রমে কেরোসিন এবং তরল অক্সিজেন ব্যবহার করা হয়।

রকেটের দ্বিতীয় স্টেজে ব্যবহৃত হয়েছে একটি C25 ইঞ্জিন। এটিও জ্বালানি হিসেবে কেরোসিন এবং তরল অক্সিজেন ব্যবহার করে।

রকেটের তৃতীয় স্টেজে যে L110 ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে তাতে জ্বালানি হিসেবে কঠিন জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। চন্দ্রযান ৩ এ কঠিন জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে সোডিয়াম ক্লোরেটের কেলাস।

৪০ দিনে প্রায় ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে চাঁদে পৌঁছাবে চন্দ্রযান।

ভারতের চন্দ্র-অভিযানের ইতিহাস

ভারত মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীতে এক অতি উজ্জ্বল স্থানে অধিকার করে আছে। এর আগে ভারত ২ টি চন্দ্র অভিযান করেছে।

২০০৮ সালের অক্টোবর মাসে ভারত তার প্রথম চন্দ্র অভিযান – চন্দ্রযান ১ এর সফল উৎক্ষেপন করে। ২০০৮ সালের ৮ ই নভেম্বর এটি চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে। এই অভিযান খরচ হয়েছিল প্রায় ₹৩৮৬ কোটি টাকা।

চন্দ্রযান ১ চাঁদে কয়েকটি অসাধারণ আবিষ্কার করে – এগুলির মধ্যে চন্দ্রযান ১ এর সেরা কৃতিত্ব চাঁদের মাটিতে জলের অণু আবিষ্কার এবং চাঁদের নকশা তৈরি করা

চন্দ্রযান ১ এর মাধ্যমে ভারত চাঁদের বহু উচ্চ-রেজোলিউশন বিশিষ্ট ছবি তোলে এবং চাঁদের টোপোগ্রাফিক্যাল ম্যাপ প্রস্তুত করে।

চন্দ্রযান ২

এরপর ২০১৯ সালের ২২ শে জুলাই ইসরো দ্বিতীয় বার চন্দ্রাভিযানের উদ্দেশ্যে উৎক্ষেপন করে চন্দ্রযান ২। চন্দ্রযান ২ চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছায় ২০ই আগস্ট।

কিন্তু ৬ ই সেপ্টেম্বর চাঁদের মাটিতে অবতরণ করার সময় একটি সফটওয়্যার গোলযোগের কারণে সেটি এর অভিপ্রেত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যার, যার কারণে এর ল্যান্ডার বিক্রম এবং রোভার প্রজ্ঞান চাঁদের মাটিতে সফল অবতরণ করতে পারেনি।

তবুও, চন্দ্রযান ২ অভিযানটিকে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ বলা যায় না। এর একটি অংশ (অর্বিটার) এখনও চাঁদের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে চলেছে এবং পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ সম্পর্কে বিভিন্ন অজানা তথ্য এখনও আমাদেরকে পাঠিয়ে চলেছে।

চন্দ্রযান ৩ এর উদ্দেশ্য

চন্দ্রযান ৩ কে চাঁদে পাঠানোর মূলত তিনটি উদ্দেশ্য, এই তিনটি উদ্দেশ্য হল:

১. চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে অবতরণ করা:

চন্দ্রযান ৩ মূল উদ্দেশ্য গুলির মধ্যে অন্যতম হল চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে অবতরণ করা। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে অবতরণ করার পর চন্দ্রযান ৩ এর মধ্যে থাকা ল্যান্ডার এবং রোভার চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নেমে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা করবে এবং সেই সম্পর্কিত তথ্য পৃথিবীতে ইসরোর বিজ্ঞানীদের কাছে পাঠাবে।

যদি চন্দ্রযান ৩ এর ল্যান্ডার চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে অবতরণ করতে পারে তাহলে চীনের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে ভারত চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে অবতরণ করার কৃতিত্ব অর্জন করবে।

চন্দ্রযান ৩ – মিশনের পর্যায় (ফেজ)

ইসরোর চন্দ্রযান ৩ মিশনকে ৩ টি পর্যায়ে (ফেজ) এ ভাগ করা হয়েছে। এই তিনটি পর্যায় বা ফেজ হল –

  1. পৃথিবীকেন্দ্রিক ফেজ
  2. চন্দ্রাভিমুখে গমনের ফেজ
  3. চন্দ্রকেন্দ্রিক ফেজ

পৃথিবীকেন্দ্রিক ফেজ

পৃথিবীকেন্দ্রিক ফেজ বা বিভক্তে আবার তিনটি উপবিভাগে ভাগ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পৃথিবীকেন্দ্রিক ফেজটি প্রায় সমাপ্ত হয়ে এসেছে।

লাল রং দ্বারা পৃথিবীর চারিদিকে চন্দ্রযানের অভিপ্রেত গতিপথ বোঝানো হয়েছে (সৌ: ইসরো)

এই ফেজটিতে চন্দ্রযান ৩ পাঁচ (৫) বার পৃথিবীতে প্রদক্ষিণ করবে। প্রতিবার প্রদক্ষিণ করার সময় পৃথিবী থেকে চন্দ্রযান ৩ এর দূরত্ব কিছুটা করে বৃদ্ধি পাবে। পঞ্চমবার দক্ষিণ করার সময় চন্দ্রযান ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাবে। এখানেই শেষ হবে প্রথম পর্যায়ে এবং শুরু হবে চন্দ্রযান মিশনের দ্বিতীয় পর্যায়।

চন্দ্রাভিমুখে গমনের ফেজ

দ্বিতীয় পর্যায়ে চন্দ্রযান পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে ছিটকে চাঁদের কক্ষপথে স্থানান্তরিত হবে। এই পর্যায়ে একটি মাত্রই উপবিভাগ বর্তমান এবং এই উপবিভাগের নামকরণ করা হয়েছে ‘গতিপথ স্থানান্তরের পর্যায়’। চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করলে শেষ হবে চন্দ্রযান ৩ এর দ্বিতীয় পর্যায় এবং শুরু হবে তৃতীয় তথা অন্তিম পর্যায়।

চন্দ্রকেন্দ্রিক ফেজ

চন্দ্রযান ৩ এর তৃতীয় পর্যায় এই মিশনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় এবং এটি ৮ টি উপ-পর্যায়ে বিভক্ত। এই পর্যায়ে চন্দ্রযান চার (৪) বার চাঁদকে প্রদক্ষিণ করবে এবং প্রতিবার প্রদক্ষিণ করার সময় একটু একটু করে চাঁদের আরও কাছে আসবে।

নীল রং দ্বারা চাঁদের চারিদিকে চন্দ্রযানের অভিপ্রেত গতিপথ বোঝানো হয়েছে (সৌ: ইসরো)

চাঁদকে ৪ বার প্রদক্ষিণ করার পর চন্দ্রযান ৩ এ একটি ইঞ্জিন বার্ন সম্পন্ন হবে, যার ফলে চন্দ্রযান চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিলোমিটার বিশিষ্ট একটি গোলাকার কক্ষপথে চাঁদকে প্রদক্ষিণ করবে। 

গোলাকার কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করার সময় চন্দ্রযানের ল্যান্ডার এবং রোভার চাঁদকে প্রদক্ষিণ করতে থাকা প্রোপালশন মডিউল থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং প্রায় ৮ কিলোমিটার / ঘন্টা বেগে ধীরে ধীরে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করবে।

চন্দ্রযান ৩ এর ল্যান্ডারটি ২৩ বা ২৪ শে আগস্ট নাগাদ চাঁদের মাটিতে অবতরণ করবে। কারণ এই সময় নাগাদ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সূর্যোদয় হবে। যদি কোনো কারণে ল্যান্ডারটি ২৩ বা ২৪ শে না করতে পারলে তাহলে আরও একমাস অপেক্ষা করে সেপ্টেম্বর এর শেষের দিকে চন্দ্রযান ৩ এর ল্যান্ডারটিকে অবতরণের প্রয়াস করা হবে।

চন্দ্রযান ৩ এর ল্যান্ডার এবং রোভার সফলভাবে চাদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করতে পারলে ল্যান্ডার থেকে রোভারটি ধীরে ধীরে চাঁদের মাটিতে অবতীর্ণ হবে এবং পরবর্তী পর্যায়ের গবেষণা শুরু করব।

ল্যান্ডার:

চন্দ্রযান ৩ এর যে অংশটি চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরণ করবে সেটি হল ল্যান্ডার। এটিতে ৪ টি পা আছে যার সাহায্যে এটি চাঁদের মাটিতে সফ্ট ল্যান্ডিংয়ের প্রয়াস করবে। চন্দ্রযান এর ল্যান্ডার যে কাজ গুলি করবে, সেগুলি হল –

  • চাঁদের পৃষ্ঠের তাপ পরিবাহিতা এবং তাপমাত্রা নিরীক্ষণ।
  • ল্যান্ডারটি যে স্থানে অবতরণ করবে তার কম্পন নিরীক্ষণ।
  • চাঁদের পৃষ্ঠে প্লাজমা ঘনত্ব এবং তার পরিবর্তন নিরীক্ষণ।

এছাড়াও ল্যান্ডারটি ক্রমাগত রোভার ও পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে।

রোভার:

চন্দ্রযান ৩ এর রোভার হল চন্দ্রযান এর সেই অংশ যেটি চাঁদের বুকে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করবে। রোভারটির ওজন প্রায় ২৬ কিলোগ্রাম এবং এটিতে ৬ টি চাকা আছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে প্রজ্ঞান

প্রজ্ঞান – চন্দ্রযান ৩ এর রোভার (সৌ: ইসরো)

রোভারটি সর্বদা ল্যান্ডার এর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে। এটি ল্যান্ডার থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ মিটার দূরে যেতে পারবে। ল্যান্ডারটি আবার পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে।

রোভার এর কাজ:

প্রায় ৬০ পাউন্ড ওজনের রোভার চাঁদে ১ চন্দ্রদিন (পৃথিবীর ১৪ দিনের সমান) পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। এই রোভারের দুটি মুখ্য অংশ:

এক্স রে – স্পেকট্রোমিটার

এক্স রে – স্পেকট্রোমিটার আলফা কণার সাহায্যে চাঁদের পৃষ্ঠতলের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করবে। এটি চাঁদের পৃষ্ঠে বিভিন্ন রকম মৌলিক সন্ধান করবে।

লেজার ইনডিউসড ব্রেকডাউন স্পেকট্রোস্কোপি:

এই যন্ত্রের সাহায্যে লেজার রশ্মি ব্যবহার করে চাঁদের পৃষ্ঠের সামান্য কিছু অংশ বাষ্পীভূত করা হবে। একটি স্পেকট্রোমিটার এর সাহায্যে সেই বাষ্পীভূত অংশকে গবেষণা করা হবে এবং তাদের বিভিন্ন পদার্থের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হবে। এই যন্ত্র দিয়ে চাঁদের পৃষ্ঠে মাটি এবং পাথরে উপস্থিত বিভিন্ন রকম পদার্থকে আণবিক পর্যায়ে পরীক্ষা করা সম্ভব হবে।

  • এছাড়াও চন্দ্রযান ৩ এ থাকবে একটি উন্নতমানের শক্তিশালী ক্যামেরা যার সাহায্যে চাঁদের পৃষ্ঠের ছবি তোলা হবে।
  • ম্যাগনেটোমিটার নামক এক যন্ত্রের সাহায্যে চন্দ্রযান ৩ চাঁদের চৌম্বক ক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা করবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *