পারমাণবিক শক্তি এবং জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তি – উভয়ই বর্তমানে ব্যবহৃত বিভিন্ন শক্তি উৎসের মধ্যে অন্যতম। পারমাণবিক শক্তি (বা নিউক্লিয় শক্তি) এবং জীবাশ্ম জ্বালানি ঘটিত শক্তি উভয়ই বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যদিও, এই ২ প্রকার শক্তির উৎসের মধ্যে বিভিন্ন পার্থক্য আছে। জীবাশ্ম জ্বালানির তুলনায় পারমাণবিক শক্তির সুবিধাও রয়েছে বেশ কিছু।
নিচে পারমাণবিক শক্তি এবং জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তির পার্থক্য সারণির আকারে তুলে ধরা হল:
পারমাণবিক শক্তি এবং জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তির পার্থক্য

বিষয় | পারমাণবিক শক্তি | জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তি |
---|---|---|
ব্যবহৃত জ্বালানী | ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম | কয়লা |
উৎপন্ন বর্জ্য | তেজস্ক্রিয় বর্জ্য | কয়লার ছাই |
কার্বন নির্গমন | নগণ্য | মাত্রাতিরিক্ত |
বায়ুদূষণ | নগণ্য | মাত্রাতিরিক্ত |
মানুষের ওপর প্রভাব | তেজস্ক্রিয় বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যা মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর (যদি, পরিবেশের মুক্ত হয়) | কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্যাস উৎপন্ন হয় এবং সরাসরি বাতাসে মেশে, এও মানুষের স্বাস্থের পক্ষে ক্ষতিকর |
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা | বর্জ্যকে আর ব্যবহার করা যায় না, নিরাপদভাবে জনজীবন থেকে দূরে রেখে দিতে হয়। | ছাই উৎপন্ন হয়, যা দিয়ে বর্তমানে ইট তৈরি করা হচ্ছে। |
ব্যবহৃত জ্বালানি:
পারমাণবিক শক্তি এবং জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তির পার্থক্য – এর বিভিন্ন বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম হল এই ২ প্রকার শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানীর প্রকারভেদ। পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন করার জন্য ব্যবহার করা হয় ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম এর মত ইউরেনিয়ামোত্তর মৌল। অপরদিকে, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয় কয়লা।
জ্বালানির পরিমাণ
যেখানে ১ কিলোগ্রাম কয়লা থেকে প্রায় ২৪ মেগাজুল এর কাছাকাছি শক্তি পাওয়া যায় সেখানে একই পরিমাণ ইউরেনিয়াম থেকে এর ৮ কোটি মেগাজুল* শক্তি পাওয়া যায়।
অন্যভাবে বলতে গেলে, ১ কিলো ইউরেনিয়াম থেকে যতটা শক্তি পাওয়া যাবে ততটা শক্তি পেতে গেলে আনুমানিক ৩০০০ টন (১ টন = ১০০০ কিলোগ্রাম) কয়লা লাগবে।
উৎপন্ন বর্জ্য:
পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের সময় তেজস্ক্রিয় পরমাণু থেকে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য উৎপন্ন হয়।
অপরদিকে, কয়লার সাহায্যে জীবাশ্ম জ্বালানি গঠিত বিদ্যুৎ উৎপাদন করার সময় তৈরি হয়।
- কঠিন বর্জ্য – কয়লার ছাই
- গ্যাসীয় বর্জ্য – কার্বন ডাই অক্সাইড এবং বিভিন্ন ক্ষতিকারক গ্যাস
কার্বন নির্গমন:
পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনকালে কার্বন নির্গমন প্রায় হয় না বললেই চলে, কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তি উৎপাদনকালে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিবেশে মেশে।
বায়ু দূষণ:
পারমাণবিক শক্তি বায়ু দূষণ ঘটাই না বললেই চলে, কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে শক্তি উৎপাদন কালে বায়ুতে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস মেশে যা বায়ু দূষণ ঘটায়। এটি পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের অন্যতম ভালো দিক।
মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব:
পারমাণবিক শক্তি থেকে উৎপন্ন বর্জ্য সরাসরি মানুষের সমাজজীবনে বা স্বাস্থ্যের ওপর তেমন প্রভাব বিস্তার করে না।
পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনকালে উৎপন্ন হয় তেজস্ক্রিয় বর্জ্য। এই তেজস্ক্রিয় বর্জ্য সমাজ জীবন থেকে বহু দূরে মাটির বহু গভীরে তৈরি বিশেষ ধরনের গহ্বরে স্থানান্তরিত করা হয়। হাজার হাজার বছর ধরে এই বর্জ্য একই রকম থেকে যায় এবং তেজস্ক্রিয়তা ছাড়াতে থাকে।
দুর্ঘটনাবশত এই বর্জ্য ছড়িয়ে পড়লে তা মানুষের স্বাস্থ্যের ভয়ংকর ক্ষতি করতে পারে। ১৯৮৬ সালের চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনা এমনই এক দুর্ঘটনার উদাহরণ, যেখানে পারমাণবিক চুল্লি বিস্ফোরণের ফলে পারমাণবিক জ্বালানি এবং বর্জ্য চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে – এর ফলে আক্রান্ত হয় বহু বহু মানুষ। ৩১ জন মানুষ এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। তেজস্ক্রিয়তা যতদূর ছড়িয়ে পড়ে ততদূর পরিত্যক্ত ভূমিতে পর্যবসিত হয়।
অন্যদিকে, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার সময় কার্বন ডাই অক্সাইড এবং যেসব ক্ষতিকারক গ্যাস নির্গত হয় সেগুলি সরাসরি বায়ুতে মেশে। এর ফলে পরিবেশ দূষণ (বায়ু দূষণ) ঘটে। মানুষ শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সেই দূষিত বায়ু শরীরে গ্রহণ করে, যার প্রভাব পড়ে সরাসরি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর।
তবে, এই শক্তি উৎপাদনের পর যেসব বর্জ্য উৎপন্ন হয় তা তেজস্ক্রিয় পদার্থের মত অতটা ক্ষতিকারক নয়।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা:
পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনকালে উৎপন্ন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব হানিকারক। এইজন্য তেজস্ক্রিয় বর্জ্যকে আর কোনোভাবেই ব্যবহার করা যায় না।
কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থাৎ কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার সময় কয়লার যে ছাই তৈরি হয় তা এখন ইট তৈরি করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ইটের নামকরণ করা হয়েছে ‘ফ্লাই অ্যাস’. এই ধরনের ইটের সুবিধা হল এই যে এগুলি খুব হালকা।
* যদিও বাস্তবে যেহেতু সব ইউরেনিয়াম পরমাণুর নিউক্লিও বিয়োজন ঘটে না, তাই বিদ্যুৎ তৈরির সময় তাত্ত্বিকভাবে যতটা শক্তি পাওয়ার কথা ততটা পাওয়া যায় না।