এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় – পূর্ব ভারতে লৌহ ইস্পাত শিল্পকেন্দ্রীভবনের কারণ।
প্রতি বছর ভারতে ব্যাপক পরিমাণে আকরিক লোহা থেকে লোহা উৎপাদন করা হয়। আকরিক থেকে লৌহ উৎপাদনে আমাদের দেশ পৃথিবীতে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল এবং চীনের পর ৪ র্থ স্থান দখল করেছে।
একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০১৯ সালে ভারতে ২১০,০০০ কিলো টন লোহা আকরিক লোহা থেকে প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবছর দেশে এতটা ব্যাপক পরিমাণে লোহা উৎপাদিত হলেও আমাদের দেশের বিশেষ কয়েকটি অঞ্চল থেকেই অধিকাংশ পরিমাণে লোহা উত্তোলিত হয়। আমাদের দেশের পূর্ব – মধ্যাংশে অর্থাৎ পূর্ব – মধ্য ভারতে সমগ্র দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে লোহা উৎপাদিত হয়।
কেন পূর্ব – মধ্য ভারতে এত বেশি পরিমাণে লোহা উৎপাদিত হয় বা কেন পূর্ব – মধ্য ভারতের লৌহ ইস্পাত শিল্পের কেন্দ্রীভবনের করেছে তা নিচে সবিস্তারে আলোচনা করা হল-
পূর্ব ভারতের লৌহ ইস্পাত শিল্প গড়ে ওঠার কারণ -
Table of Contents
Toggleআকরিক লোহা
লৌহ ইস্পাত শিল্প একটি ভারহ্রাসমান শিল্প। অর্থাৎ এই শিল্পে কাঁচামাল এর থেকে উপন্ন দ্রব্যের ওজন অনেকটাই কম হয়। তাই লৌহ ইস্পাত শিল্পের মতো শিল্প গুলিতে কাঁচামাল উৎপাদনের স্থান (বা খনিজ পদার্থের ক্ষেত্রে উত্তোলনের স্থান ও শিল্প কেন্দ্রের মধ্যে দূরত্ব কম হয় ততটাই ভালো।
লৌহ ইস্পাত শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় আকরিক লোহা পূর্ব – মধ্য ভারতে প্রচুর পরিমাণে উত্তোলিত হয়। পূর্ব – মধ্য ভারতের ওড়িশার গরুমহিষাণী, বাদামপাহাড়, বোনাই, সুলাইপাত, কেউনঝড় ইত্যাদি অঞ্চল, ঝাড়খন্ড রাজ্যের গুয়া এবং নোয়ামুন্ডি, ছত্রিশগড় রাজ্যের বায়লাডিলা ইত্যাদি অঞ্চল থেকে যথেষ্ট পরিমাণে আকরিক লোহা উত্তোলন করা হয়।
আরও পড়ুন – ভারতের জলবায়ুর নিয়ন্ত্রক
কয়লা
লৌহ ইস্পাত শিল্পের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল হলো কয়লা। খনি থেকে প্রাপ্ত আকরিক লোহা থেকে অশুদ্ধি দূর করে সেই লোহাকে ব্যবহারযোগ্য লোহায় পরিণত করতে গেলে লোহাকে গলানোর দরকার হয়। কয়লার সাহায্যে এই লোহা গলানোর কাজ করা হয়। কাজেই লৌহ-ইস্পাত শিল্পকেন্দ্রের কাছাকাছি অঞ্চলে কয়লাখনি থাকলে কয়লা আনয়নের জন্য কম অর্থ ব্যয়িত হয়।
পূর্ব – মধ্য ভারতে বহু কয়লা খনি অবস্থিত এবং এখান থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে কয়লা উত্তোলিত হয় বলে এই অঞ্চলে লৌহ ইস্পাত শিল্পের বিকাশ ঘটেছে।
আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রানিগঞ্জ-আসানসোল অঞ্চল, ঝাড়খন্ড রাজ্যের ঝরিয়া, বোকারো, গিরিডি, বিহার রাজ্যের রামগড়, ডালটনগঞ্জ ও উড়িষ্যার তালচের থেকে প্রচুর পরিমাণে কয়লা উত্তোলিত হয়।
প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাঁচামালের সহজলভ্যতা
আকরিক লোহা এবং কয়লা ছাড়াও লৌহ ইস্পাত শিল্পের অন্যান্য বিভিন্ন কাঁচামালের দরকার পড়ে। এইসব প্রয়োজনীয় কাঁচামালের মধ্যে অন্যতম কিছু কাঁচামাল হলো চুনাপাথর, ডলোমাইট, ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতি। উড়িষ্যার বীরমিত্রপুর, গাংপুর অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে চুনাপাথর, কালাহান্ডি অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ম্যাঙ্গানিজ এবং গাংপুর অঞ্চল থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ডলোমাইট পাওয়া যায়।
পূর্ব – মধ্য ভারতে এইসব কাঁচামালের সহজলভ্যতার জন্য এখানে লৌহ ইস্পাত শিল্প বিকাশ লাভ করেছে।
আরও পড়ুন – অতিরিক্ত ভৌমজল উত্তোলনের প্রভাব
পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ শক্তির যোগান
লৌহ ইস্পাত শিল্পে লোহা গলানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন হয়। পশ্চিমবঙ্গের কোলাঘাট, ফারাক্কা, দুর্গাপুর, ওড়িশার তালচের, ঝাড়খণ্ডের বোকারো ইত্যাদি অঞ্চল থেকে পর্যাপ্ত তাপ বিদ্যুৎ এবং ম্যাসেঞ্জার বাঁধ, পাঞ্চেত বাঁধ, মাইথন বাঁধ, হিরাকুদ বাঁধ ইত্যাদি থেকে যথেষ্ট পরিমাণে জল বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।
ভূ-প্রকৃতিগত সমস্যা বিশেষ না থাকায় সহজেই তারে করে এই উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রয়োজনীয় অংশ সরাসরি লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র গুলোতে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এজন্য পূর্ব – মধ্য ভারতের লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র গুলি কেন্দ্রীভূত হয়েছে।
পর্যাপ্ত জলের যোগান
লৌহ ইস্পাত শিল্পে আকরিক উত্তোলন ধৌতকরণ, তাকে শিল্প ব্যবহার উপযোগী করে তোলার জন্য বিভিন্ন কাজে প্রচুর পরিমাণে জল এর প্রয়োজন হয়। এত বেশি পরিমাণ জল ভূমির তলা থেকে উত্তোলন করা সম্ভব নয়, কাজেই এই জল উত্তোলনের সবথেকে আদর্শ ক্ষেত্র হল নদী।
পূর্ব – মধ্য ভারতের যে অঞ্চলে লৌহ ইস্পাত শিল্পের বিকাশ ঘটেছে সেই অঞ্চলে বহু নদীর সমাবেশ। এই সব নদী থেকে উত্তোলন করা যায় বলে এই অঞ্চলে লৌহ ইস্পাত শিল্পের প্রভূত উন্নতি ঘটেছে।
এই নদী গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নদী হল : দামোদর, সুবর্ণরেখা, অজয়, ব্রাহ্মণী প্রভৃতি।
সুলভ ও সুদক্ষ শ্রমিক
যে কোন শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ হল শ্রমিক। শ্রমিক সুদক্ষ এবং সুলভ হলে তা যে কোন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। তাই যেখানে সুলভে সুদক্ষ শ্রমিক পাওয়া যায় সেখানে সহজেই শিল্প গড়ে উঠতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা প্রভৃতি রাজ্য বেশি ঘনবসতিপূর্ণ। (বিহার ভারতের সবথেকে বেশি জনঘনত্বপূর্ণ রাজ্য এবং পশ্চিমবঙ্গ এই তালিকায় ২য় স্থানে অবস্থান করছে (২০১১ এর জনগণনা অনুযায়ী)। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী রাজ্য যেমন উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড-ও বেশ ঘনবসতিপূর্ণ।
ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল হওয়ার কারণে এই সব স্থানে প্রচুর পরিমাণে সুলভ এবং সুদক্ষ শ্রমিক পাওয়া যায়। পর্যাপ্ত সুলভ এবং সুদক্ষ শ্রমিক থাকতে এই অঞ্চলে লৌহ ইস্পাত শিল্পের বিকাশ ঘটেছে।
উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা
পূর্ব – মধ্য ভারতে যেসব স্থানে লৌহ ইস্পাত শিল্পের বিকাশ ঘটেছে সেইখানকার বেশিরভাগ ভূমি সমতল প্রকৃতির। সমভূমি প্রকৃতির ভূমিরূপ হওয়ায় এখানকার স্থলপথের পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত। এইসব অঞ্চলে যেমন উন্নত মানের যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে তেমনি রয়েছে উন্নত রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা।
যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত মানের হওয়ার জন্য বাইরে থেকে কাঁচামাল শিল্প কেন্দ্র নিয়ে আসতে এবং শিল্প কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত দ্রব্যাদি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে সহজেই সরবরাহ করা সম্ভব হয়। এজন্য এইসব স্থানে লৌহ ইস্পাত শিল্প কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে এমন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য জাতীয় সড়ক হল – NH 2, NH 6. NH 33 প্রভৃতি। সমগ্র অঞ্চলটিতে জালের মতো বিছিয়ে রয়েছে পূর্ব – মধ্য এবং মধ্য পূর্ব – মধ্য রেলওয়ে।
শুধুমাত্র স্থল যোগাযোগ ব্যবস্থায়ই নয়, এই অঞ্চলে বন্দরের সান্নিধ্যও রয়েছে। এখানে থেকে অনতিদূরে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, হলদিয়া বন্দর এবং ওড়িশার পারাদ্বীপ বন্দর প্রভৃতি।
এইসব কারণেই পূর্ব – মধ্য ভারতে লৌহ-ইস্পাত শিল্পের বিকাশ ঘটেছে এবং শিল্প কেন্দ্র গুলির কেন্দ্রীভবন ঘটেছে।